জামশেদ ইবনে মুসলিমঃ নিকলীতে বিগত বছরের তুলনায় বিভিন্ন প্রকারের সুস্বাদু মাছের পরিমাণ অনেকাংশে কমে গেছে। সেই সাথে শুঁটকি ব্যবসায়ীদের যেনো মাথায় পড়েছে হাত পড়েছে। এর জন্যে প্রকৃতি দায়ী নাকি মানুষের সৃষ্টি অনিয়মই দায়ী? এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বের জন্ম অনেকের মাঝে। স্থানীয় জেলেদের দাবি অচিরেই অনিয়ম দূরীকরণে সরকারী-বেসরকারী ফলপ্রসূ উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ কুফল বয়ে আনবে। জেলে সম্প্রদায়ের অনেকেই জীবিকা নির্বাহের তাগিদে বাপদাদার এ পেশা ছেড়ে দিয়ে ভিন্ন পেশায় প্রবেশ করতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ মাছ রপ্তানিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে সুদীর্ঘ অতীতকাল থেকেই। এ দেশের মিঠাপানির সুস্বাদু মাছের কদর গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উৎস হয়ে উঠে মুক্ত জলাশয় থেকে আহরিত মাছ। তবে এই বছর কিশোরগঞ্জের নিকলী অনেকখানিই তার ব্যতিক্রম। সেখানকার জেলে পরিবারের পাশাপাশি কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের উপার্জনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়ে উঠে মুক্ত জলাশয় থেকে মৎস্য আহরণ। জেলে পরিবার ছাড়াও অনেকেই নিজেদের খাবারের পাশাপাশি টুকিটাকি মাছ বিক্রিও করে থাকে। মাছ বিক্রির আশায় আর উপার্জনের নেশায় পথ চেয়ে বসে থাকে মৌসুমের এই সময়টিতে এই সম্প্রদায়ের লোকেরা। বিধিবাম সাম্প্রতিক বর্ষা মৌসুমে কাঙ্খিত পরিমাণে পানির দেখা না পেয়ে আশানুরূপ উপার্জনে গুড়েবালি বলেও অনেকে হতাশায় ভেঙ্গে পড়েন!
কিশোরগঞ্জের নিকলী ও তার আশেপাশের এলাকায় অসংখ্য জেলেদের মাঝে চলতি মৌসুমে এ হাহাকারের দৃশ্য ফুটে উঠেছে। এর জন্যে একদিকে যেমন প্রকৃতি দায়ী, অপরদিকে প্রকৃতির উপর বিরূপ আচরণের জন্যে মানুষ নিজেই অনেকাংশে দায়ী বলে অনুসন্ধানে উঠে আসে।
জানাগেছে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, মৌসুমের উপযুক্ত সময়ে অনাবৃষ্টি, দেরিতে হাওরে পানির আগমন, কাঙ্খিত পরিমাণে পানি না আসা, পোনা মাছ নিধন, কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারসহ বিভিন্ন ধরণের অবৈধ কারেন্ট জালের ব্যবহার। এছাড়াও শুকনো মৌসুমে পানি শুকিয়ে মাছ ধরা, অসাধু ব্যক্তি যখনি নিধনকারী বিষ প্রয়োগে মৎস্য শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এমনকি বিভিন্ন প্রকারের অপরিকল্পিত বাধ নির্মাণসহ অপরিকল্পিত রাস্তা নির্মাণই এর জন্যে অনেকাংশে দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়। তাছাড়াও সরকারীভাবে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে যখনি বিভিন্ন ধরণের ডিম ওয়ালা মাছ শিকার আর পোনা মাছ নিধনে স্বার্থন্বেষী মহলের জড়িত থাকার বিষয়। তাছাড়াও অনাবৃষ্টির কারণে অসহনীয় গরমে খাল বিলের পানি যখনি মাছের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে এমন পরিস্থিতিতেও বিভিন্ন প্রকারের মাছ মারা যায়। সরেজমিনে দেখা গেছে অনাবৃষ্টির কারণে মাছের অভয়াশ্রম শুকিয়ে যায়। মূলত অনুপোযোগী পরিবেশ তৈরির কারণে বিলুপ্ত হতে চলেছে রানী ও বেধরে মাছসহ বেশ কিছু প্রজাতির সুস্বাদু মাছ। তবে তুলনামূলক অনেক ক্ষেত্রে বেড়েছে চাষের মাছের পরিমাণ। যা খাদ্যের ঘাটতি পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে।
সরেজমিনে হাওর সংলগ্নের নিকলী উপজেলার গুরই ইউনিয়নের কৈবতপাড়ায় দেখা মিলে হতাশাগ্রস্থ অসংখ্য জেলে ও জেলেনির। সেখানকার ৬০ বছরের কাছাকাছি ভক্ত নামের এক কৈবর্তসহ যুবক সুজিত ও তার সমবয়সী এ সম্প্রদায়ের অসংখ্য লোকের আফসোসের ভাষ্য রাজনৈতিক প্রভাবে নেতা-কর্মীদের হাতে এখন মৎস্যের কার্ড! সুবিধাবঞ্চিত প্রকৃত মৎস্যজীবিরা। নদী-নালা ও খাল বিলের কিছু অংশ সরকারের কাছে থেকে ইজারা এনে ভোগদখলে থাকে অনেক বেশি। অধিকার বঞ্চিত হয় প্রকৃত জেলে। লাভের নেশায় নিয়মবহির্ভূতভাবে মাছ আহরণে ব্যস্ত থেকে নামধারী জেলেরা। মাছের বংশবিস্তারেও বাধাগ্রস্ত করে। তাই সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে সঠিক তদারকিরও দাবি তোলেন। এমন অনিয়ম শুধু নিকলীতেই নয় বরং গোটা বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলের অসংখ্য স্থানেই এমন দৃশ্য বিদ্যামান। বলা চলে সারা দেশের খন্ড চিত্র।
নিকলীর শুঁটকির এলাকা বলে খ্যাত কৈবতপাড়ার অসংখ্য নারী পুরুষের হতাশার ভাষ্যমতে, চলতি মৌসুমে একদিকে কাঙ্খিত পানি আসেনি। অপরদিকে দেরীতে পানি আসায় হাওরে মাছও তুলনামূলক কম। এছাড়া আকারেও অনেকখানিই ছোট।
দামেও তুলনামূলক অনেক বেশি। অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর হাওরের পুঁটি মাছ, বেলে মাছ, বাইমমাছ, টাকি মাছসহ অসংখ্য প্রজাতির মাছ তাদের শুঁটকির যোগ্যতা হারাতে বসেছে। তাই পরিপুষ্ট পুটি মাছের শুঁটকিসহ সকল মাছের শুঁটকি নিয়েও দুশ্চিন্তায় ভোগছেন স্থানীয় শুঁটকি ব্যবসায়ীরা। মাছের দাম বিবেচনায় শুঁটকিতে লাভবান হতে পারবে না বলে যুক্তি তুলে ধরেন।